চলন বিলের মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বাংলাদেশের অন্যতম একটি বড় বিল হচ্ছে চলনবিল। প্রতিবছর বর্ষাকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা চলন বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আসে। চলন বিলের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জানার আগ্রহ রয়েছে অনেকের মধ্যে তারই ধারাবাহিকতায় চলনবিলের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরার সামান্যতম প্রয়াস মাত্র। চলন বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আপনাকে সশরীরে যেতেই হবে। আজকের এই আর্টিকেলে চলন বিলের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করা হয়েছে যাতে করে ভ্রমণ পিপাসুরা চলন বিলের সৌন্দর্য উপভোগ এর পূর্বে এই বিল সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা নিতে পারে।
চলন বিলের মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
চলনবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কেমন বিশেষ করে বর্ষায় চলন বিলের অপরূপ সৌন্দর্য, চলনবিল কোথায় অবস্থিত? চলন বিলের আশপাশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান, চলনবিলে কিভাবে যাবেন? কোথায় থাকবেন? কি খাবেন এই সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছি। আশা করি আজকের আলোচনাটি আপনাদের অবশ্যই ভালো লাগবে। আজকের এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়লে আপনি হারিয়ে যাবেন চলনবিলের গভীর জলে।

চলন বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

বর্ষার জলরাশির সাথে সাদাকালো মেঘের লুকোচুরি খেলা মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে আপনার যদি আগ্রহ থাকে তাহলে আর দেরি না করে চলে আসুন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিল দেখতে। ষড়ঋতুর এই দেশে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রূপে ধরা দেয় চলনবিল। 

বর্ষাকালে সাগরের মত বিশাল জলরাশিতে ভরপুর চলন বিলের জলের ঢেউ সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। শরৎকালে শান্ত জলরাশি বুকে টুকরো টুকরো সবুজের সমারোহ। হেমন্ত ঋতুতে পাকা ধানের সোনালী পাথার চোখ জুড়িয়ে দেয়। 

শীত ঋতুতে বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য নিদর্শন দেখা যায় জলহীন চলনবিলের বুকে। ফসলের সমারোহ বিশেষ করে সরিষা ফুলের হলুদ চাদরে ঢেকে যায় পুরো চলনবিল। শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় সকালের স্নিগ্ধ রোদ্র সেই সাথে শালিক, দোয়েল, শ্যামা পাখির কিচিমিচি আপনাকে বিমোহিত করবে। 
পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠার আগেই ফসল বোনা ফসল তোলায় কৃষকের ব্যস্ততা আপনার মনে দাগ কাটবে। চলন বিলের বুক চিরে বয়ে চলা নদীর দুই ধারে সাদা কাশফুল শরতের স্নিগ্ধতার কথা মনে পড়ে যাবে।গ্রীষ্ম ঋতুতে চলনবিল যেন রুক্ষ হয়ে যায় চারিদিকে ধুধু আর মরীচিকার খেলা। 

তবে চলন বিলের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো ধরা দেয় বর্ষাকালে ও শীতকালে এই দুটি ঋতুতে চলনবিলের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি উপভোগের।

বর্ষায় চলনবিল।

বর্ষায় বিস্তীর্ণ জলরাশি বুকে জেলে ভাইয়ের ছোট নৌকায় মাছ ধরা, ঘন কালো আকাশ হতে হঠাৎ বজ্রসহ বৃষ্টি, সাদা সাদা বকের সারি উড়ে যাওয়ার দৃশ্য, পানকৌড়ির জল স্নান, অঝোর বৃষ্টির মাঝে চলন বিলের বুক চিরে ছুটে চলা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ভয়ংকর ঢেউ আছড়ে পড়া, দূর দূরান্তে দ্বীপের ন্যায় গ্রামগুলো দেখে মন জুড়িয়ে যাবে। 

একেক ঋতুতে একেক ভাবে চলনবিলের সৌন্দর্য ধরা দিলেও বর্ষাকালেই চলনবিলের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি উপভোগের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা আসে চলনবিলের সৌন্দর্য দেখার জন্য।
চারিদিকে অথৈ জল ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট খাল বিল গুলোকে একই মালায় গেঁথে ফেলে চলন বিল যেন রুদ্র মূর্তি ধারণ করে। 

ছোট ছোট অসংখ্য বিল ও খালের মিলনমেলায় সৃষ্ট হয়েছে এই বিল। চলন বিলের উল্লেখযোগ্য খাল ও বিলগুলোর নাম হচ্ছে পিপরুল, ডাঙ্গাপাড়া, লারোর, তাজপুর, নিয়ালা, মাজগাও, চোনমোহন, শাতাইল, দারিকুশি, গজনা, বড় বিল, সোনাপাতিলা সহ বেশ কিছু বিল।

চলন বিলের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট-বড় ১৬টি নদী। বর্ষাকালে নদী এবং বিল একাকার হয়ে যায় চেনার উপায় নেই কোন দিক দিয়ে নদী বয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদী দিয়ে নৌকা চলে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া যায়। 
চলনবিলের উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হচ্ছে আত্রাই, করোতোয়া, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, সহ আরো অনেক নদী। তবে চলন বিলের অন্যতম প্রধান দুটি নদী হচ্ছে আত্রাই নদী ও বড়াল নদী। খাল বিল ডোবা অসংখ্য জলরাশিতে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই বিলের মাছের রয়েছে আলাদা স্বাদ তাই এই বিলের মাছের কদর অন্যান্য বিলের মাছের চেয়ে সব সময় বেশি থাকে। 

চলন বিল দেশি মাছের একটি অভয়ারণ্য বলা চলে এই বিলে প্রচুর পরিমাণে দেশী প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।চিতল,মাগুর,কৈ,টেংরা,পুটি, সরপুটি,শিং,কালিবাউস,গজার,বোয়াল সহ আরো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বর্ষার পরে শুষ্ক মৌসুমে যখন বিলের পানি শুকিয়ে আসে তখন এই বিলে ধরা পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ।

চলন বিল কোথায় অবস্থিত।

এতক্ষণ আমি চলন বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করলাম। এবার আপনাদের জানাবো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলন বিল কোথায় অবস্থিত। চলনবিল বাংলাদেশের কোন কোন জেলায় জুড়ে অবস্থিত এটি আমরা কম বেশি সবাই জানি তারপরও আপনারা যারা নতুন এ বিষয়ে জানার আগ্রহ রয়েছে তাদের জন্য বলছি। 

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ চলনবিল একটা সময় দেশের উত্তরবঙ্গের নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া এই পাঁচটি জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে বিস্তৃত হলেও বর্তমানে বিশেষ করে নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় চলনবিলের বেশিরভাগ অংশ রয়েছে। 
নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার প্রায় নয়টি উপজেলা নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। চলন বিলের উত্তরের অংশের সীমানা ছড়িয়েছে বগুড়া জেলার শেরপুর ও নন্দীগ্রাম এবং নওগাঁ জেলার আত্রাই ও রাণীনগর উপজেলার সীমানা পর্যন্ত। দক্ষিণে পাবনা জেলার আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী উপজেলা সীমানা পর্যন্ত। 

পূর্ব দিকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সীমানা পর্যন্ত। পশ্চিমে ছড়িয়েছে নাটোর জেলার নলডাঙ্গা ও সদর উপজেলা পর্যন্ত। চলন বিলের মধ্যে অবস্থিত উপজেলাগুলো হল নাটোর জেলার নলডাঙ্গা, সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ উপজেলা। 

পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলা। পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলন বিলের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিলোমিটার এবং উত্তর থেকে দক্ষিনে এর প্রশস্ত প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। ১৯৮৬ সালের জরিপ মতে চলন বিলের আয়তন প্রায় ২০৭২ বর্গ কিলোমিটার কিন্তু বর্তমানে এই বিলের আয়তন হ্রাস পেয়ে ১১৫০ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। 

ছোট বড় ৫০ টিরও বেশি বিল নিয়ে চলন বিল গড়ে উঠেছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিল হচ্ছে ছয়আনি বিল, সাধুগাড়ি বিল, কুড়ালিয়া বিল, ঝাকড়ার বিল, কচুগাড়ি বিল, চাতরার বিল, চেচুয়ার বিল, খোলার বিল, ধলার বিণ, ধরইল বিল, হরি বিল, হুলহুরীয়া বিল, তাড়াশের বড় বিল প্রভুতি।
চলন বিলের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি সড়ক মহাসড়ক ও রেলপথ চলে গিয়েছে। নাটোর- বগুড়া আঞ্চলিক মহাসড়ক, নাটোর- সিরাজগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়ক এবং ঈশ্বরদী- ঢাকা রেলপথ। ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে নাটোর রাজশাহী অথবা অন্যান্য জেলায় আসা যাওয়ার পথে এই বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। 

নাটোর থেকে বগুড়া হয়ে উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলায় যাওয়ার সময় চলনবিল দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া রাজশাহী রংপুর দিনাজপুর ঢাকা মধ্যে যেসব ট্রেন চলাচল করে এসব ট্রেনে আসা যাওয়ার সময় উল্লাপাড়া- চাটমমোহর অংশে এই বিলের সৌন্দর্য দেখা যায়।

চলন বিলের আশেপাশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান।

চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসে আপনি চলন বিলের আশপাশের অন্যান্য দর্শনে স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারবেন। বিশেষ করে নাটোরের উত্তরা গণভবন, নাটোর রাজবাড়ী, গুরুদাসপুর খুবজিপুর গ্রামে দেখা যাবে চলনবিল জাদুঘর। 

নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত পতিসর কাচারি বাড়ি, পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার শাহী মসজিদ, ফরিদপুর উপজেলার বনওয়ারি নগর রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার দিলপাশা রেলওয়ে স্টেশন, তারাশের রাধা গোবিন্দ মন্দির, শাহজাদপুর উপজেলা রবীন্দ্রনাথের কাছারি বাড়ি উল্লেখযোগ্য।

চলন বিলে কিভাবে যাবেন।

রাজধানী ঢাকা হতে চলন বিলে যাওয়ার জন্য বাস ট্রেন উভয় যানবাহন ব্যবহার করতে পারেন। আপনি যদি বাসে চলন বিলে যেতে চান তাহলে ঢাকা হইতে রাজশাহী অথবা নাটোর গামী যেসব বাস রয়েছে। যেমন- ন্যাশনাল ট্রাভেল, গ্রামীণ ট্রাভেল, দেশ ট্রাভেল, একতা, হানিফ এন্টার প্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন এসব বাসে করে নাটোরের কাছি কাটা নামতে পারেন এরপর সেখান থেকে স্থানীয় যানবাহনে চলন বিল যেতে পারবেন।

ঢাকা থেকে ট্রেনে চলনবিল দেখার জন্য যেতে চাইলে ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ধুমকেতু, একতা, সিল্কসিটি, লালমনি, পদ্মা সহ উত্তরবঙ্গগামি অন্যান্য ট্রেনে আপনি উল্লাপাড়া, বড়াল ব্রিজ, চাটমোহর এবং নাটোর স্টেশনে নেমে চলনবিলের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখতে পারবেন।

খাওয়া দাওয়া ও থাকবেন কোথায়।

প্রিয় পাঠক আপনি উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন যে চলন বিল সিরাজগঞ্জ নাটোর ও পাবনা জেলায় অবস্থিত। চলন বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, উল্লাপাড়া, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, সিংড়া, ললডাঙ্গা, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায় যেতে হবে। 

উপজেলা পর্যায়ে খাওয়া-দাওয়ার ভালো পরিবেশ পাবেন কিন্তু রাত্রি যাপনের তেমন কোনো সুযোগ নেই রাত্রি যাপনের ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার সদরে যেতে হবে।

শেষ কথাঃ

বাংলাদেশের অন্যতম একটি বড় বিল হচ্ছে চলন বিল ছোট বড় বেশ কয়েকটি বিলের সমন্বয়ে এই বিল গড়ে উঠেছে। চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটক আসে বিশেষ করে বর্ষা ঋতুতে চলন বিলের অথৈ পানিতে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানোর জন্য দূর দূরান্তের হাজার হাজার পর্যটক আসে। 

অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টের কারণে চলনবিল তার চিরাচরিত্র রূপ হারাতে বসেছে। চলন বিলের জীববৈচিত্র্য কে রক্ষা করার জন্য এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতি জরুরী। এছাড়া এই চলনবিলকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের একটি পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।

comment url