ঘুরে আসুন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান

গাজীপুর জেলার ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এর নাম আপনি হয়তো শুনেছেন। এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম জাতীয় উদ্যান। ছুটির দিনে অবসর সময়ে চাচ্ছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ঘুরে আসতে। তাহলে আপনার জন্য আজকের এই আর্টিকেলটি হতে চলেছে খুবই তথ্যবহুল।
ঘুরে আসুন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান
এই আর্টিকেলে লেখনীর মাধ্যমে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃশ্যপট আপনার মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করব। পাশাপাশি আপনি জানবেন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান কোথায় অবস্থিত, কিভাবে যাবেন, থাকা খাওয়ার সুবিধা, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের পিকনিক স্পট, ভাড়া ও প্রবেশ মূল্য এই বিষয়গুলো সম্পর্কে।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান।

বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা শহরের নিকটবর্তী একটি জেলা হচ্ছে গাজীপুর। গাজীপুর জেলার সুনাম ও সু- খ্যাতি রয়েছে অনেক আগে থেকেই। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর, শিল্প ও কারখানা, সুনামধন্য ব্যক্তিবর্গের জন্মস্থান হচ্ছে গাজীপুর। গাজীপুর জেলার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো এই জেলায় রয়েছে ছোট বড় বেশ কয়েকটি বনাঞ্চল। 
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় উদ্যান রয়েছে গাজীপুরে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালে এই উদ্যান কে সরকারিভাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় উদ্যানের আদলে ৫০২২ সেক্টর জমিতে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান গড়ে তোলা হয়। ১৯৭৪ সালে এই বনাঞ্চলে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও ১৯৮২ সাল থেকে এটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান কোথায় অবস্থিত।

গাজীপুর জেলায় যে কয়টি দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। একদম নতুন যারা গাজীপুর ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের আগ্রহী তাদের অবশ্যই জানা উচিত এই উদ্যানটি গাজীপুরের কোথায় অবস্থিত। 

ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে এবং গাজীপুর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের একদম পাশেই ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। গাজীপুর সদর উপজেলা ও শ্রীপুর উপজেলা নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছেন এই উদ্যানের বনাঞ্চল।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে প্রবেশপথে প্রধান ফটকের আপনি দেখতে পাবেন বনের সর্ববৃহৎ পশু হাতির ভাস্কর্য যা দেখে আপনার মন জুড়িয়ে যাবে। প্রথম দর্শনে আপনি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্যতা আঁচ করতে পারবেন। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালি ঘেড়া সবুজের নয়নাভিরাম অপরূপ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। 

উদ্যানের সবুজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পাখির কিচিমিচি ডাক শুনতে শুনতে বনের মেঠো পথ ধরে যেতে যেতে মনের অজান্তে কখন বনের গভীরে চলে গেছেন তা বোঝার উপায় নেই। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রাম নিতে পারেন রাস্তার পাশে থাকা বেঞ্চ কিংবা ছাউনিতে। বনের মধ্যে কোথাও কোথাও ধানক্ষেত চোখে পড়বে। রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বড় পুকুর। 
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সবুজের মাঝে আপনি যখন হারিয়ে যাবেন তখন মনে হবে আধুনিক যান্ত্রিকতায় আর না ফিরতে। এখানকার সবুজে ঘেরা নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশের কটেজ ও বিশ্রামাগারে থেকে যেতে ইচ্ছে করবে।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে আপনি যদি রাত্রি যাপনের সুযোগ পেয়ে যান এটি হবে আপনার জন্য অন্য রকমের এক অভিজ্ঞতা। গভীর রাত্রে জোনাকি পোকার আলো, ঝিঝিঁ পোকার ডাক, শিয়াল হাক, বানরের চিৎকার আপনাকে নিয়ে যাবে আফ্রিকার কোন গভীর বনে বা দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন বনের গভীরে।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের গাছ গাছালি।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রায় ২২০ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ প্রজাতির বিভিন্ন রকমের গাছ, ১৯ প্রজাতির গুল্ম, ৩ প্রজাতির পাম, ২৭ প্রজাতির ঘাস, ২৪ প্রজাতির লতা, ১০৪ প্রজাতির ঔষধি গাছ। তবে এই উদ্যানের মূল বৃক্ষ হচ্ছে শাল গাছ। 

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের বনভূমিকে ক্রান্তীয় আদ্র পর্ণমোচী বৃক্ষের বন বলা হয়। এই বনের বনাঞ্চলকে গজারি বন বলে অনেকে চেনে। শুষ্ক মৌসুমে শালবনের পাতাগুলো ঝরে পড়ে তা পচে যায় এই জন্য এই বনাঞ্চলকে ক্রান্তীয় আদ্র পচনশীল বৃক্ষের বন বলা হয়।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের পশুপাখি।

একটা সময় ছিল এই বনাঞ্চল পশুপাখিতে ছিল ভরপুর। এই বনে দেখা মিলতো বাঘ, হাতি, চিতাবাঘ, সিংহ, বানর, ময়ূর, হরিণ সহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি। কালের বিবর্তনে বন উজারের ফলে এইসব পশুপাখি আর দেখা যায় না।
তারপরও বলতে হয় এই বনে রয়েছে প্রায় ১৩ স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী। এই উদ্যানে বর্তমানে যেসব পশুপাখি দেখা যায় বা দেখা মেলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গন্ধগোকুল, শিয়াল, বাঘদাস, খরগোশ, সজারু, বেজি, গুইসাপ, কচ্ছপ।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের পিকনিক স্পট।

রাজধানী ঢাকা শহরের অতি সন্নিকটে হয় প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এই উদ্যানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ভ্রমণ করেন। শুষ্ক মৌসুমে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে এই উদ্যানটি বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ব্যাপক দর্শনার্থীর লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই উদ্যানে প্রতি বছর পিকনিকের আয়োজন করে থাকে। 

ভ্রমণ প্রত্যাশীদের কাঙ্ক্ষিত চাহিদার কথা বিবেচনা রেখে এই উদ্যানের বেশ কয়েকটি স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে পিকনিক স্পট। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পিকনিক স্পটের নাম আপনাদের সুবিধার্থে তুলে ধরবো। যেমন- আনন্দ, কাঞ্চন, সোনালু, অবকাশ, অবসর ও বিনোদন।
দর্শনার্থীদের কথা মাথায় রেখে এখানে বেশ কয়েকটি কটেজ ও রেস্ট হাউস গড়ে তোলা হয়েছে। যদিও রাত্রি যাপনের কোন অনুমতি সচরাচর দেয়া হয় না। পিকনিক স্পট কিংবা রেস্ট হাউস ব্যবহার করতে চাইলে বন বিভাগের মহাখালী কার্যালয় থেকে আগাম বুকিং ও অনুমতি নিতে হয়। প্রিয় পাঠক, আশা করি আলোচনার এই অংশটি আপনাদের খুবই উপকারে আসবে।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ভাড়া ও প্রবেশ মূল্য।

প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত একজন দর্শনার্থী এই জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ মূল্য জনপতি ২০ টাকা। উদ্যানের ভিতরে থাকা শিশু পার্ক, ওয়াচ টাওয়ার, মিনি চিড়িয়াখানা, পাবলিক টয়লেট এর জন্য আপনাকে আলাদা আলাদা টিকিট করতে হবে না।
যোগাযোগ ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের যে কোন জেলা থেকে গাজীপুর ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এ ভ্রমণ করতে আগ্রহী ভ্রমণ পিপাসুদের প্রথমে আসতে হবে গাজীপুর জয়দেবপুর চৌরাস্তায়। এরপর সেখান থেকে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে একটু সামনে এগোলেই বাস, সিএনজি, লেগুনা পেয়ে যাবেন।পরিবহন ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ২০ থেকে ৩০ টাকা লাগতে পারে। বাস, সিএনজি, লেগুনা ধরে উত্তর দিকে ৩ কিলোমিটার এগোলে হাতের ডান পাশে চোখে পড়বে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান।

থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান সৌন্দর্য উপভোগ করা শেষে আপনাকে ফিরে আসতে হবে। এখানে থাকার জন্য কোন অনুমতি দেয়া হয় না। এর আশেপাশের ব্যক্তির উদ্যোগে বেশ কিছু কটেজ ও রেস্ট হাউস গড়ে তোলা হয়েছে আপনি চাইলে এখানে রাত্রি যাপন করতে পারেন যদিও এখানকার কটেজ রেস্ট হাউসগুলো ভাড়া তুলনামূলক বেশি। 
আর্থিক খরচ কমানোর কথা বিবেচনা করলে আপনাকে আসতে হবে গাজীপুর শহরের জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এখানে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। তুলনামূলক অল্প টাকায় এখানে আবাসিক হোটেলে থাকার সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে খাওয়ার কথা যদি বলতে হয় তাহলে আপনাকে মনে রাখতে হবে এই উদ্যান এর ভিতরে খাওয়া-দাওয়ার কোন সুব্যবস্থা নেই। সবচেয়ে ভালো হয় খাবার নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলে।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের সতর্কতা।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের কিছু সতর্কতার কথা আপনাদের সাথে শেয়ার না করলে আলোচনার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাহলে চলুন এই উদ্যান ভ্রমণের ক্ষেত্রে কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এই বিষয়গুলো জেনে আসি।
  • নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এই উদ্যান ভ্রমণে অবশ্যই দলবেঁধে যেতে হবে। একা একা ভ্রমণ একেবারে অনিরাপদ।
  • পূর্বেই বলেছি এই উদ্যানে রাত্রি যাপনের কোন অনুমতি নেই। তাই এই বিষয়ে সচেতন থাকুন।
  • উদ্যানের ভেতরে মাছ ও পশু শিকার করা সম্পূর্ণ নিষেধ। তবে নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে আপনি পুকুরে মাছ শিকার করতে পারেন।
  • উদ্যানের ভেতরে চলতে চলতে আপনার চোখে পড়বে বিশেষ কিছু সাইনবোর্ড যেগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
  • বনের ভেতরে উচ্চ শব্দের গান বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো সূম্পন্ন নিষেধ।
  • ভ্রমণের সময় অবশ্যই সাথে পানির বোতল, সানগ্লাস ও অ্যান্টিসেপটিক রাখুন।
  • উদ্যানের নিরাপত্তা এলাকার বাহিরে যাওয়া একেবারেই বিপদজনক।

লেখকের মন্তব্যঃ

আধুনিক যান্ত্রিকতার এই যুগে মানসিক প্রশান্তির পাওয়ার জন্য মানুষ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় পেলেই মানুষ প্রকৃতির সাধ গ্রহণ করতে চায়। ব্যস্ত নগরী যান্ত্রিক কোলাহল থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচার জন্য অনেকেই চেষ্টা করেন। আর এই জন্যই গাজীপুর জেলার বিভিন্ন প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষেরা ভিড় জমান। 

সুযোগ পেলেই ছুটে আসেন প্রকৃতির কোলে। দুঃখের বিষয় এসব বনাঞ্চল নগরায়নের ফলে দিন দিন কমে আসছে। প্রকৃতি মানুষ পশু-পাখি বাঁচাতে হলে বনাঞ্চল রক্ষায় আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। দিন দিন যে হারে বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এটা মানব সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ। 

আসুন আমরা সকলেই আওয়াজ তুলি বনাঞ্চল রক্ষা করি। আজকের আর্টিকেলটি পড়ে নিশ্চয়ই আপনার মাঝে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের আগ্রহ বহুগুণ বেড়েগে যদি তাই হয়, তাহলে এটি হবে আমার আর্টিকেল লেখার সার্থকতা।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।

comment url