অবসরে ঘুরে আসুন ঢাকা জেলার ১৫টি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা জেলায় রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান। এসব ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন। ঢাকার বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানসমূহ দর্শনার্থীদের কাছে পরিচিত করে তোলার জন্য আজকে আমি ঢাকা জেলার ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানসমূহ সংক্ষিপ্ত আকারে আপনাদের সামনে তুলে ধরব। আজকের এই আর্টিকেলটি ধৈর্য সহকারে পড়ার পর আপনারা এইসব স্থানসমূহ সম্পর্কে কিছু ধারণা পেয়ে যাবেন। চলুন আর দেরি না করে ঢাকা জেলার ১৫টি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান কি কি এই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে পরিচিতি মূলক আলোচনা শুরু করা যাক।
ঢাকা জেলার ১৫টি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান।
আহসান মঞ্জিল নামটি বাংলাদেশের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলি এলাকার বুড়িগঙ্গার নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। এটি ছিল ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারির সদর কাচারি। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আহসান মঞ্জিল প্রথম নির্মাণ কাজ শুরু করেন শেখ এনায়েত উল্লাহ নামের এক জমিদার।
শেখ এনায়েতুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মতিউল্লাহ এটি ফরাসিদের কাছে বিক্রি করে দেন। পরবর্তীতে ১৮৩৫ সালে খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসীদের কাছ থেকে এটি কিনে নেন এবং মূল ভবনের আমূল পরিবর্তন করেন। নবাব খাজা আলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র নবাব আব্দুল গনি এটি নির্মাণ করেন এবং তার পুত্র আহসানুল্লাহ অনুসারে এই ভবনের নাম রাখেন আহসান মঞ্জিল।
আহসান মঞ্জিল একসময় ঢাকা শহরের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ভুবন ছিল। তৎকালীন সময়ে আহসান মঞ্জিল ছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে উচু ভবন। আহসান মঞ্জিল এর সাথে জড়িত রয়েছে কয়েকশো বছরের পুরনো ইতিহাস।
বাংলাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের স্থাপত্য নিদর্শন গুলোর মধ্যে যেগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোর মধ্যে উন্নতম হলো ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত লালবাগ কেল্লা। লালবাগ কেল্লার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটি প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে। লালবাগ কেল্লা মুঘল সাম্রাজ্যের উন্নততম একটি নিদর্শন।
মুঘল আমলের সুবেদার আজম শাহ ১৬৭৮ সালের লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সুবেদার আজম শাহ ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র। সুবেদার আজম শাহ বাংলাকে প্রায় ১৫ মাস সুবেদার হিসেবে শাসন করেন। সুবেদার আজম শাহ দিল্লি চলে যাবার পূর্বে একটি মসজিদ ও একটি দরবার হল নির্মাণ করেন।
সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবার পূর্বেই তাকে দিল্লী চলে যেতে হয় সেই জন্য লালবাগ কেল্লা নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালের পুনরায় বাংলার সুবেদার হিসাবে ঢাকা এসে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৬৮৪ সালে সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরি বিবির মৃত্যু ঘটে। কন্যার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খাঁ এই দুর্গের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।
তিনি কন্যার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এটিকে অপয়া মনে করেন তাই এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করেন।শায়েস্তা খাঁ ঢাকা থেকে চলে যাবার পর এই দুর্গের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমতে থাকে। অবশেষে ১৮৪৪ সালে এই দুর্গ টির নাম আওরঙ্গবাদ কেল্লা পরিবর্তন করে লালবাগ কেল্লা দেয়া হয়। তখন থেকে এই দুর্গটি লালবাগ কেল্লা বা লালবাগ দুর্গা নামে পরিচিত।
কার্জন হল রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ভবন যা পুরা কীর্তি হিসেবে স্বীকৃত। এটি নির্মাণ করা হয় ঢাকা কলেজের ব্যবহারের জন্য। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুসদের কিছু শ্রেণীকক্ষ ও পরীক্ষা হল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন এটির ভিত্তি স্থাপন করেন তার নাম অনুসারে পরবর্তীতে এটি কার্জন হল করা হয়। বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার পর প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য যে সকল ভবনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কার্জন হল।
আরো পড়ুনঃ ঘুরে আসুন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান
কার্জন হল স্থাপত্য শৈলী দেখে ভ্রমণ পিপাসুদের মুগ্ধতা বহুগুণ বেড়ে যাবে। দৃষ্টিনন্দন এই ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখার জন্য দেশ ও দেশের বাইরে থেকে বহু পর্যটক এখানে আসেন।
মুঘল শাসন আমলে নির্মিত পুরান ঢাকার একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থান হচ্ছে জিঞ্জিরা প্রাসাদ। এই প্রাসাদের সঙ্গে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ও তার পরিবারের সদস্যদের স্মৃতি জড়িত রয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে জিঞ্জিরা প্রাসাদ। জিঞ্জিরা শব্দের অর্থ হলো আইসল্যান্ড বা দ্বীপ।
বর্তমানে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে শোয়ারিঘাট এলাকায় এই জিঞ্জিরা প্রাসাদ অবস্থিত। জিঞ্জিরা প্রাসাদ নির্মাণ করেন সুবেদার নবাব ইব্রাহিম খাঁ ১৬৮৯ সালের দিকে। জিঞ্জিরা প্রাসাদ বিশেষভাবে আলোচিত হওয়ার একটি বিশেষ কারণও রয়েছে নবাব সিরাজ দৌলার পরিবারকে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল।
মীরজাফরের পুত্র মিরনের চক্রান্তে নবাব সিরাজ দৌলার মা আমেনা, খালা ঘসেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফন্নেসা ও তার শিশু কন্যা সহ সবাইকে এই প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়। নবাব সিরাজদৌলার পরিবারকে দীর্ঘ ৮ বছর জিঞ্জিরা প্রাসাদ বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এছাড়া মুঘল শাসকদের অনেককেই এই দুর্গে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।
জনশ্রুতি আছে মুঘল আমলে জিঞ্জিরা প্রাসাদ সঙ্গে লালবাগ দুর্গের যোগাযোগ রক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশ দিয়ে একটি সুরঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল। মুঘল সেনাপতি ও কর্মকর্তারা এই সুরঙ্গ দিয়ে আসা-যাওয়া করতেন। লালবাগ দুর্গে এরকম একটি সুরঙ্গ পথ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে এই সুরঙ্গ পথে যে একবার যায় সে ফিরে আসে না।
রোজ গার্ডেন হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক প্রাচীন ভবন। এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের টিকাটুলি এলাকায় অবস্থিত একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ভবন। রোজ গার্ডেন কে ঘিরে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। ঋষিকেশ দাস নামে একজন ব্যবসায়ী এই রোজগার্ডেন গড়ে তোলেন।
কথিত আছে ঋষিকেশ দাস তৎকালীন জমিদার নরেন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরীর বাগান বাড়ি বলধা গার্ডেনে এক জলসায় গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর তিনি রোজ গার্ডেন তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৩১ সালের পুরান ঢাকায় ঋষিকেশ দাস রোডে এটি তৈরি করেন।
দেশ-বিদেশ থেকে মাটি ও গোলাপের চারা নিয়ে এসে তিনি এই ভবনের রোপন করেন এবং এই ভবনের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে তিনি রোজ গার্ডেন ভুবন খান বাহাদুর আব্দুর রশিদের কাছে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হন। খান বাহাদুর আব্দুর রশিদ এই ভবনটির নতুন নামকরণ করেন রশিদ মঞ্জিল।
মৌলভী কাজী আব্দুর রশিদ মারা গেলে ১৯৪৪ সালে গার্ডেনের মালিকানা পান তার বড় ছেলে কাজী মোঃ বশির। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৭০ সালের এই ভবনটি বেঙ্গল স্টুডিও ও মোশন পিকচারস লিমিটেড কাছে ইজারা দেয়া হয়। এই ভবনে বিভিন্ন নাটক ও সিনেমার শুটিং করা হয়ে থাকে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার এই ভ্রমণটি ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ৯০০ টাকার মূল্যে ক্রয় করে নেন। সর্বমোট ২২ বিঘা জমির উপর এ রোজগার্ডেন ভবনটি নির্মিত হয়েছে। এই ভবনের সাথে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনের ইতিহাস। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এই বাড়িতেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়।
আবুল হাশেমের নেতৃত্বে তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের রোড গার্ডেন প্রাসাদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকায় তৈরিকৃত একটি ঐতিহাসিক ভবন হচ্ছে ছোট কাটরা। আনুমানিক ১৬৬৩ সাল থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে এই ভ্রমণটি নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৬৭১ সালের দিকে এটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত।
আরো পড়ুনঃবঙ্গবন্ধু রেল সেতু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
আকৃতিতে এটি বড় কাটড়ার মত হলেও আসলে এটি বড় কাটরা মত এত বড় নয় এ কারণেই হয়তো এর নামকরণ করা হয়েছে ছোট কাটরা। ইংরেজ আমলে ছোট কাটার বেশ কিছু সংযোজন করা হয়েছিল। ১৮১৬ সালে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক লিওনার্দ এখানে ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল খুলে ছিলেন।
শায়েস্তা খানের আমলে ছোট কাটরা নির্মিত হয়েছিল সরাইখানা বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য। ১৯ শতকের শেষের দিকে অথবা ২০ শতকের প্রথমদিকে এটি ছিল নবাব পরিবারের দখলে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বড় কাটরা। বড় কাটরা ঢাকার চকবাজারের দক্ষিণে অবস্থিত মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সরাইখানা। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪৪ সাল থেকে ১৬৪৬ এর মধ্যে এই ভবনটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়।
প্রথমে এতে শাহ সুজার বসবাস করার কথা থাকলেও পরে এটি মুসাফিরখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। একসময় স্থাপত্য সৌন্দর্যের আধার থাকলেও বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসের দার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
বাহাদুর শাহ পার্ক রাজধানী ঢাকা, পুরান ঢাকা এলাকার সদরঘাটে সন্নিকটে লক্ষী বাজারে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। বর্তমানে একটি পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। এই স্থানটি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। ১৮ শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের ডিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল।
যাকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আন্টাঘর। সেখান থেকে এসেছে আন্টাঘর কথাটি। ক্লাবঘরের সাথেই ছিল একটি ময়দান যা আন্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই এ সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার সেই থেকেই এই স্থানের নামকরণ করা হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক।
১৯৫৭ সালের আগে পর্যন্ত পার্টি ভিক্টোরিয়া নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর এক প্রহসন মুলক বিচারে ইংরেজ শাসকরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সৈন্যদের তারপর জনগণকে ভয় দেখানো জন্য সিপাহীদের লাশ এনে এখানে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। ১৯৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।
এই পার্কের স্মৃতিসৌধটি চারটি পিলারের উপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি অবকাঠামো উপরে রয়েছে একটি ডম অপর পাশে রয়েছে একটি ওবেলিস্ক যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়া সিংহাসন আহরণের কথা মনে করিয়ে দেয়।
১৮ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত ঢাকার একটি দর্শনীয় মসজিদ হচ্ছে তারা মসজিদ। প্রতিদিন দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীরা এই মসজিদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আসেন। তারা মসজিদ পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত। জানা যায় ১৮ শতকে ঢাকার মহল্লা আলে আবু সাঈদ এ আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর।
ঢাকার ঢনাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি।জমিদার মির্জা গোলাম পীর মির্জা মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসাবে এটি তখন বেশ পরিচিত। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সেই সময় জাপানের রঙিন চিনি টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকার্যে।
১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনের আত্মউৎসর্গকারী শহীদদের রক্তের স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এখানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। এটি ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল খুবই দ্রুত এবং অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শহীদ মিনার নির্মাণ করেন এবং পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পুলিশ এই মিনারটি ভেঙে ফেলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে শহীদ মিনার তৈরি করা হয় এবং পুনরায় পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সরকারের নির্দেশে তা ভেঙে ফেলেন।
অবশেষে ১৯৫৬ সালে আবু হোসেন সরকারের মুখ্য মন্ত্রিত্বের আমলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বর্তমান স্থান নির্বাচন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তৎকালীন পূর্ত সচিব জনাব আব্দুর সালাম খান মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চূড়ান্তভাবে একটি স্থান নির্বাচন করেন।
১৯৫৬ সালে মন্ত্রীর হাতে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা থাকলেও তাতে উপস্থিত জনতা প্রবল আপত্তি জানায় এবং ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ রিস্কাচালক আওয়ালের ৬ বছরের মেয়েকে দিয়ে এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়।
রায়ের বাজার বদ্ধভূমি স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান। এখানেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের একদম শেষের দিকে ১৪ই ডিসেম্বর বাংলার সূর্য সন্তানদের ধরে নিয়ে এসে নৃশংসভাবে শহীদ করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর এটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে এখানে শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অন্যান্য পেশাজীবী বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে এসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের এই আত্মত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৯৩ সালের তৎকালীন সরকার এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এই বদ্ধভূমি নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৯ সালের তৎকালীন সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন। সমগ্র অবকাঠামোটি আমাদের বিভিন্ন ধরনের মেসেজ দিয়ে থাকে। যেমন- রায়ের বাজারে আদি এটা ইটখোলায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ পড়েছিল বা ফেলে রাখা হয়েছিল।রায়ের বাজার বদ্ধভূমি স্মৃতিসৌধ যে দেয়ালটি দুই দিকে ভাঙ্গা এই ভগ্ন দেওয়াল ঘটনার দুঃখ ও শোকের গভীরতা নির্দেশ করে।
দেওয়ালের দক্ষিণ পশ্চিম পাশে একটি বর্গাকার জানালা আছে এই জানালা দিয়ে পেছনের আকাশ দেখা যায়।বাঁকা দেওয়ালের সম্মুখে একটি স্থির জলাধার রয়েছে জলাধারের ভেতর থেকে কালো গ্রেনাইট পাথরের একটি স্তম্ভ উঠে এসেছে এটি শোকের প্রতীক।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি স্থান হল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এটি ঢাকা শহরের একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক উদ্যান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব নাম ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দান। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পরবর্তীতে রমনা রেসকোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসেবে ডাকা হতো এই উদ্যানকে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের পর অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে এই মাঠটি কে কখনো কখনো ঢাকা রেসকোর্স ময়দান হিসেবে ডাকা হতো। ব্রিটিশ আমলে প্রতি রবিবার ঘোর দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রমনা রেসকোর্স নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বিশিষ্ট এক জাতীয় নেতার নামানুসারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেয়ে রেসকোর্স ময়দানের এক নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং এখানেই তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসের সাথে জড়িত রয়েছে এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম। ১৯৭১ সালের ৭- ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মাঠেই বিশাল জনসভার মাধ্যমে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পরপরই শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুক্তিযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সবার কাছে খুবই পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত বেসামরিক বাঙালি ও অবাঙালিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি স্মারক স্থাপনা। এটি ঢাকা জেলার সাভার উপজেলায় অবস্থিত। স্মৃতিসৌধের সাতটি স্তম্ভ আছে যা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি আন্দোলনকে নির্দেশ করে। এর নকশা প্রণয়ন করেছেন স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন।
এখানে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের ১০ টি গণ কবর রয়েছে। বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশ সফর আক্রমণ করলে এই স্মৃতিসৌধের শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রাচারের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের তৎকালের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকায় আরিচা মহাসড়কের পাশে নবীনগরে এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্মৃতিসৌধের নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং নক্সার আহ্বান করা হয়। ১৯৭৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রাপ্ত ৫৭ টি নকশার মধ্যে স্থপতি মইনুল হোসেন বর্ণিত নকশা গৃহীত হয় এবং এই নকশার আদলেই তৈরি করা হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
ঢাকার একটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা যা মিরপুরে অবস্থিত। এটি ১৯৫০ সালে হাইকোর্ট চত্বরে জীবজন্তুর প্রদর্শনশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একটি চিড়িয়াখানা। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালের এটি মিরপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। চিড়িয়াখানাটির উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন।
বছরের প্রায় ৩০ লক্ষ দর্শনার্থী ঢাকা চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে থাকেন। ১৯৫০ সালের ২৬ ডিসেম্বর কৃষি সমবায় ও সাহায্য মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় একটি চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এরই প্রেক্ষিতে চিড়িয়াখানাটি ঢাকা হাইকোর্টের কাছে বেশ কয়েকটি দাগ যুক্ত হরিণ, বানর এবং হাতি নিয়ে সেই সময় শুরু হয়েছিল।
ঢাকা চিড়িয়াখানার আয়তন প্রায় ৭৫ হেক্টর। চিড়িয়াখানার চত্বরে ১৩ হেক্টরের দুটি দৃষ্টিনন্দন প্রশস্ত লেক রয়েছে।
ঢাকা জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেন এটি বাংলাদেশের জাতীয় উদ্যান হিসাবেও সবার কাছে অধিক পরিচিত। ঢাকা মিরপুর চিড়িয়াখানার পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেন অবস্থিত। এই গার্ডেনে রয়েছে চেনা অচেনা নানান ধরনের গাছ। ১৯৬১ সালে প্রায় ২০৮ একর জায়গার উপর এই উদ্যানটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
এই জাতীয় উদ্যানটিতে রয়েছে নানান ধরনের ফুল ও ফলের বাগান। উদ্যানটি প্রায় ২.৫ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট হওয়ায় ফুল ও ফলের বাগান ছাড়াও রয়েছে পুকুরদিঘি নানান ধরনের ঔষধি প্রজাতির গাছ। প্রতিদিন ঢাকা ও ঢাকার বাহিরের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আসেন।
শেষ কথা
বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানসমূহ সম্পর্কে ধারাবাহিক আলোচনায় ঢাকা জেলার বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান আপনাদের সামনে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরলাম। আমার এই পোস্টটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দেবেন। পরবর্তীতে আমি ঢাকার পাশের একটি জেলা গাজীপুরের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানসমূহ সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে আসব। সেই পর্যন্ত আপনারা সুস্থ থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।
comment url