শায়েস্তা খানের লালবাগ কেল্লা কোথায় অবস্থিত
আপনি কি একজন ভ্রমণপিপাসু! আপনি কি লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান! তাহলে আমাদের এই পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। বাংলাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের স্থাপত্য নিদর্শন গুলোর মধ্যে যেগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত লালবাগ কেল্লা।
লালবাগ কেল্লা কোথায় অবস্থিত? লালবাগ কেল্লা কে নির্মাণ করেন? সর্বোপরি লালবাগ কেল্লার ইতিহাস জানার আগ্রহ তাদের জন্য আজকের এই পোস্টটি।
লালবাগ কেল্লার ইতিহাস।
বর্তমানে আমরা যে লালবাগ কেল্লাটি দেখতে পাই এটি প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে। লালবাগ কেল্লাটি মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অন্যতম নিদর্শন। মুঘল আমলের সুবেদার আজম শাহ ১৬৭৮ সালে লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সুবেদার আজম শাহ ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র।
সুবেদার আজম শাহ বাংলাকে প্রায় ১৫ মাস সুবেদার হিসাবে শাসন করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সুবেদার আজম শাহ তার শাসন কার্য সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুর্গের নির্মাণ কাজ শেষ হবার পূর্বেই ম্যারাটা বিদ্রোহ দমনের জন্য পিতার আহ্বানে তিনি দিল্লি চলে যান।
সুবেদার আজম শাহ দিল্লি যাওয়ার পূর্বে এখানে একটি মসজিদ ও একটি দরবার হল নির্মাণ করেন। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবার পূর্বেই তাকে দিল্লী চলে যেতে হয় এজন্য লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে পুনরায় বাংলার সুবেদার হিসেবে ঢাকায় এসে দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন।
১৬৮৪ সালে সম্রাট শায়েস্তা খাঁনের প্রিয় কন্যা পরী বিবির মৃত্যু ঘটে। কন্যার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খাঁ এই দুর্গের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। তিনি কন্যার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই দুর্গ কে অপয়া বলে মনে করেন তাই এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করেন। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা থেকে চলে যাবার পর এই দুর্গের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমে যেতে থাকে।
এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করা। মুঘল সাম্রাজ্যের সমাপ্তির পর দুর্গটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। অবশেষে ১৮৪৪ সালে এই দুর্গ টির নাম আওরঙ্গবাদ কেল্লা পরিবর্তন করে লালবাগ কেল্লা দেয়া হয়। তখন থেকে এই দুর্গটি লালবাগ কেল্লা বা লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিত।
লালবাগ কেল্লা কোথায় অবস্থিত।
বাংলাদেশের মোগল সাম্রাজ্যের স্থাপত্য শিল্প গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লালবাগ কেল্লা। শুরুতে এটি লালবাগ কেল্লা নামে পরিচিত ছিল না। লালবাগ কেল্লার অপর নাম আওরঙ্গবাদ কেল্লা। ঢাকা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বুড়িগঙ্গা তীরে লালবাগ কেল্লাটি অবস্থিত।
লালবাগ কেল্লা কে নির্মাণ করেন।
১৬ শতকে এই উপমহাদেশে মুঘল শাসনামলের সূচনা হয়। মুঘল শাসন আমলের সীমানা প্রাচীর ছিল সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ। এই শাসনামলের সর্বশেষ সম্রাট আওরঙ্গজেব এর তৃতীয় পুত্র সুবেদার আজম শাহ বাংলার শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে সর্বপ্রথম লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন তবে এই কেল্লার নির্মাণ কাজ তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।
পরবর্তীতে বাংলার আরেক সুবেদার শায়েস্তা খাঁ লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনিও এই কেল্লার নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারেন নাই। আমরা বর্তমানে লালবাগ কেল্লার বা দুর্গের যে স্থাপনা সমূহ দেখতে পাই সেগুলো লালবাগ কেল্লা নির্মাণের অসমাপ্ত স্থাপনা সমূহ।
লালবাগ কেল্লায় কি কি আছে।
বিভিন্ন গবেষণার ফলস্বরূপ এটি ধারণা করা হয় যে দুর্গটি তিনটি প্রধান স্থাপনার সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। মসজিদ, পরিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই- আম এই ভবনগুলোর সাথে দুটি বিশাল ত্বরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর। কেল্লার পূর্বপাশে দেওয়ানি আম ও হাম্মাম খানা, পশ্চিমে মসজিদ এবং পরিবির সমাধি।
একটি পানির নালা তিনটি ভুবনকে পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে। এছাড়া জনশ্রুতি আছে এই কেল্লায় একটি গভীর সুরঙ্গ রয়েছে এই সুরঙ্গ দিয়ে বুড়িগঙ্গার অপর তীরে যাওয়া যেত যদিও এটি প্রমাণিত নয়।
লালবাগ কেল্লা দেওয়ান-ই- আম:
লালবাগ কেল্লার এই ভবনটি দুটি কাজে ব্যবহার হতো হাম্মাম খানা যা ছিল সুবেদারদের বাসভবন এবং দেওয়ানে আম যা ছিল সুবেদারদের বিচারালয়। এই ভবনের নিচ তলা ছিল বাসভবন তথা হাম্মাম থানা আর উপরের তলা ছিল আদালত বা দেওয়ানে আম।
মুঘল সাম্রাজ্যের বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বসবাস করতেন এবং এটাই ছিল তার বিচারালয় বা আদালত। এখান থেকে তিনি সমস্ত বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
লালবাগ কেল্লা পরিবির সমাধি স্থল:
লালবাগ কেল্লার মূল তিনটি স্থাপনার মধ্যে অন্যতম একটি স্থাপনা হল পরী বিবির সমাধিস্থল। এখানে পরিবিবি সমাহিত আছেন। শায়েস্তা খাঁ তার কন্যার স্মরণে এই মনোমুদ্ধকর মাজারটি নির্মাণ করেন। লালবাগ কেল্লার তিনটি বিশাল দরজার মধ্যে বর্তমানে জনসাধারণের জন্য যে দরজাটি উন্মুক্ত রয়েছে এই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়বে পরী বিবির সমাধি।
আমরা সচরাচর পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও টেলিভিশনের খবরে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে লালবাগ কেল্লার যে স্থাপনাটি দেখি সেটি হল মূলত পরিবির সমাধিস্থল বা মাজার। পরীবিবি যার আসল নাম ইরান দুখত রহমত বানু ছিলেন বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রাণপ্রিয় কন্যা।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মোহাম্মদ আজম এর সাথে ১৬৬৮ সালে পরী বিবির বিয়ে হয়েছিল। ১৬৮৪ সালে পরিবির অকাল মৃত্যুর পর তাকে নির্মাণাধীন এই কেল্লাতে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে তার সমাধিস্থলে মাজার নির্মিত হয়।
লালবাগ কেল্লা শাহী মসজিদ:
লালবাগ কেল্লার মূল স্থাপনা মধ্যে অন্যতম আরেকটি স্থাপনা হলো শাহী মসজিদ। এটি লালবাগ কেল্লার পশ্চিম অংশে অবস্থিত। সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তিন গম্বুজওয়ালা এই দুর্গ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
এই উপমহাদেশে মুঘল শাসনামলে যতগুলো মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে তার সবগুলো মসজিদের নির্মাণশৈলী প্রায় একই রকমের। বর্তমানে এই মসজিদটি মুসল্লিদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
লালবাগ কেল্লা জাদুঘর:
লালবাগ কেল্লাটি বর্তমানে একটি জাদুঘরের রূপান্তর করা হয়েছে। নবাব শায়েস্তা খানের বাসভবন যেখানে রয়েছে সেটি একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। জাদুঘরটিতে দেখার মত অনেক কিছু রয়েছে। মুঘল শাসনামলের বিভিন্ন নিদর্শন আপনি দেখতে পাবেন।
মুঘল শাসন আমলে হাতে আঁকা ছবি দেখা মিলবে সেখানে। সুবেদার শায়েস্তা খাঁর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্র সেখানে সযত্নে রাখা হয়েছে। এছাড়া তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সেই সময়কার প্রচলিত মুদ্রা ইত্যাদি রয়েছে।
লালবাগ কেল্লা কবে বন্ধ থাকে।
লালবাগ কেল্লাটি বর্তমানে একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সবার কাছে ব্যাপক পরিচিত। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক লালবাগ কেল্লার সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখার জন্য আসেন। আপনারা অনেকেই জানতে চেয়েছেন লালবাগ কেল্লা কবে বন্ধ থাকে এই বিষয়টি সম্পর্কে। লালবাগ কেল্লা সপ্তাহের রবিবার সহ সকল ধরনের সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে।
আরো পড়ুনঃ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে যাওয়ার উপায়
এখন আমি আপনাদের বলব লালবাগ কেল্লা খোলার সময়সূচী গ্রীষ্মকালে সকাল ১০.০০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬.০০টা পর্যন্ত লালবাগ কেল্লা খোলা থাকে আর শীতকালে সকাল ৯.০০ টা থেকে বিকাল ৫.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১.০০ টা থেকে ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকে।
টিকিট প্রাপ্তির স্থান:
লালবাগ কেল্লার মূল ফটকের ঠিক ডান পাশে রয়েছে টিকিট কাউন্টার জনপতি প্রাপ্তবয়স্ক একজন দর্শনার্থীর টিকিটের মূল্য ১০ টাকা তবে ৫ বছরের কম বাচ্চাদের জন্য টিকিট কাটতে হয় না। যে কোন বিদেশী দর্শণার্থীদের জন্য টিকিটের মূল্য ১০০ টাকা।
লালবাগ কেল্লায় যাওয়ার উপায়।
বাংলাদেশের যে কোন জেলা থেকে সড়ক পথ, রেলপথ ও আকাশ পথ ব্যবহার করে খুব সহজেই লালবাগ কেল্লায় যাওয়া যায়।
সড়ক পথ:
বাংলাদেশের যে কোন জেলা থেকে বাসযোগে রাজধানী ঢাকার গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে নেমে বাস, সিএনজি, লেগুনা যোগে আপনি খুব সহজেই লালবাগ কেল্লায় যেতে পারবেন।
বাংলাদেশের যে কোন জেলা থেকে ট্রেন যোগে প্রথমে আপনাকে কমলাপুর স্টেশনে আসতে হবে এরপর সেখান থেকে বাস, সিএনজি, ট্যাক্সি, রিক্সা যোগে আপনি লালবাগ কেল্লায় যেতে পারবেন।
আকাশ পথ:
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আপনি যদি ঢাকার লালবাগ কেল্লা ভ্রমণে আসতে চান তাহলে আপনাকে প্রথমে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে তারপর বাস, সিএনজি, ট্যাক্সি ও বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং ব্যবহার করে খুব সহজেই লালবাগ কেল্লায় পৌঁছতে পারবেন।
থাকার ব্যবস্থা।
ঢাকা শহরের পুরান ঢাকা অংশে অবস্থিত লালবাগ কেল্লার আশেপাশে যে সকল আবাসিক হোটেল মোটেল রয়েছে তার কয়েকটি নাম ও ঠিকানা নিচে দেয়া হলো।
হোটেল হোয়াইট হাউস ইন্টারন্যাশনাল: এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পর্যটকেরা এই হোটেলে অবকাশ যাপন করতে পারেন। এটি লালবাগ কেল্লা থেকে ২ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত।
ঠিকানা:৮১/বি/২, হোসনী দালাল রোড, চকবাজার, ঢাকা।
হোটেল সেভেন স্টার আবাসিক: লালবাগ কেল্লা থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এই হোটেলটি অবস্থিত।
ঠিকানা: ঠাটারী বাজার বটতলা, ওয়ারী, ৯৯ বিসিসি রোড, ঢাকা- ১২০৩।
হোটেল ভিক্টোরিয়া আবাসিক: এটি একটি উন্নত মানের আবাসিক হোটেল। যে কোন পর্যটকের কাছে হোটেলের সৌন্দর্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় হবে। লালবাগ কেল্লা থেকে ২.৫ কিলোমিটার পূর্বদিকে এই হোটেলটির অবস্থান।
ঠিকানা: ৮৩ নাজিমুদ্দিন রোড, চানখারপুল, ঢাকা।
হোটেল রয়েল প্যালেস আবাসিক: কেল্লা থেকে মাত্র ৩.৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম দিকে এই হোটেলটির অবস্থান।
ঠিকানা:৩১/ডি তোপখানা রোড, ঢাকা ১০০০।
শেষ কথাঃ
আজিই ঘুরে আসুন ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন আওরঙ্গবাদ দুর্গ বা লালবাগ কেল্লা। আজকের এই পোস্টে সংক্ষিপ্ত পরিসরে লালবাগ কেল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তুলে ধরা চেষ্টা করেছি। এর প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অবশ্যই আপনাকে লালবাগ কেল্লা ভ্রমণ করতে হবে।
আর হ্যাঁ ভ্রমণ করার পূর্বে একটি কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে আপনার সন্তানকে নিয়ে অবশ্যই ভ্রমন করবেন। কেননা আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের এসব ইতিহাস সম্পর্কে জানানো আপনার আমার সকলের দায়িত্ব।
সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।
comment url