হেবা দলিল কি ও হেবা কে কাকে করতে পারে
মুসলিম সমাজের রক্তের সম্পর্কে আত্মীয়দের মধ্যে এক ধরনের দলিল সম্পাদন হয়ে থাকে যেটাকে আমরা হেবা দলিল বলি। হেবা দলিল সম্পর্কে সমাজে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে যা একেকজনে একেক ভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিয়ে থাকে। হেবা দলিল সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবে পারিবারিকভাবে সমস্যার সৃষ্টি হয়। হেবা দলিল কি ও কে কাকে হেবা দলিল করতে পারে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব আশা করি সমস্ত আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়বেন।
এর পাশাপাশি আপনারা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আরো জানতে পারবেন হেবা দলিলের শর্ত, হেবা দলিল বাতিল করার নিয়ম, হেবা দলিল কি বাতিল করা যায়, হেবা দলিলের খরচ, হেবা ও দানের মধ্যে পার্থক্য কি এই বিষয়গুলো সম্পর্কে। তাহলে চলুন মূল আলোচনা শুরু করা যাক।
হেবা দলিল কি?
হেবা একটি আরবি শব্দ। এর বাংলা আভিধানিক অর্থ হল দান। মুসলিম আইন অনুযায়ী কোন মুসলমান ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে কোন প্রকার অর্থ বিনিময় ছাড়া নিজের সম্পত্তি রক্তের সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তির কাছে দান করতে পারেন সে দানকে হেবা বলা হয়।
হেবা এবং দান শব্দদ্বয়ের আভিধানিক অর্থ একই হলেও সম্পত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। রক্তের সম্পর্ক নেই এমন কাউকে হেবা দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি দেওয়া যায় না। রক্তের সম্পর্ক নেই এমন কাউকে চাইলে একজন মুসলিম সম্পত্তি দান করতে পারেন।
অন্য কথায় বলা যায় কোন ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় তার সমস্ত সম্পত্তি বা সম্পত্তির অংশ বিশেষ রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়র নিকট লিখে দিতে চাইলে হেবা করতে পারবেন। যাকে আমরা হেবা দলিল নামে জানি।
অর্থ বা বিনিময় ছাড়া কোন ব্যক্তি রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়র মধ্যে স্বেচ্ছায় সম্পত্তি হস্তান্তর করে করার জন্য যে দলিল সম্পাদন করেন তাকে হেবা দলিল বলে। হেবা দলিল বাধ্যতামূলকভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। ২০০৫ সালের ১ জুলাই থেকে হেবা দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত হেবা দলিলের কার্যকারিতা নেই।
হেবা কত প্রকার।
উপরের সংক্ষিপ্ত আকারের হেবা দলিল কি এটি আপনি জানতে পারলেন। এবার আপনার জানা দরকার হেবা দলিল কত প্রকার ও কি কি? এ বিষয়টি জানা থাকলে হেবা দলিল সম্পাদন করতে আপনার সহজ হবে। চলুন এবার দলিল কত প্রকার এই বিষয়টি এখন জেনে নেয়-
হেবা প্রধানত দুই প্রকার। যথাঃ
সাধারন হেবাঃ যে হেবা দলিল করতে গিয়ে দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে কোন প্রকার আর্থিক ও অন্য কোন লেনদেন হয় না তাকে সাধারন হেবা বলে। অর্থাৎ সাধারণ হেবা হচ্ছে কোন কিছুর বিনিময় ছাড়া স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, ভালোবেসে, স্নেহ করে দাতা তার সম্পত্তি অন্য কাউকে দান করে দেওয়াকে সাধারণ হেবা বলে।
হেবা- বিল- আওয়াজঃ হেবা- বিল- আওয়াজ হচ্ছে এক ধরনের বিনিময় হেবা। এটি সম্পাদন করতে গিয়ে দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে আর্থিক বিনিময় হয়ে থাকে। তাই এই ধরনের হেবাকে অনেকে বিনিময় হেবা বলে।
হেবা দলিলের শর্ত।
হেবা দলিল সম্পাদন করতে গেলে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। এই শর্তগুলোর খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা হেবা দলিল এর কার্যকারিতা এ শর্তগুলোর উপর টিকে থাকে। কোন একটি শর্ত যদি না মানা হয় তাহলে হেবা দলিল এর কোন মূল্য থাকেনা।
তাই হেবা দলিল সম্পাদনের পূর্বে অবশ্যই শর্তগুলো সম্পর্কে সাধারণ একটি ধারণা থাকা দরকার। চলুন হেবা দলিলের গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো জেনে আসি-
- দাতা অথবা দানকারী স্বেচ্ছায় হেবা করছেন বলে ঘোষণা করা;
- দান গ্রহীতা সেই দান গ্রহণ করছেন বলে স্বীকার করা;
- হেবা দাতা যে সম্পদ সম্পত্তি দান করছেন তা গ্রহণকারীকে বুঝিয়ে দেওয়া বা দখলে দেওয়া;
- দানের বিনিময়ে কোন অর্থ দাবি না করা তবে দলিলদাতা দলিল গ্রহীতা উদ্দেশ্যে বিশেষ কিছু শর্ত সন্নিবেশ করতে পারে;
এসব শর্তের কোন একটি শর্ত পূরণ যদি অসম্পূর্ণ থাকে তাহলে হেবা দলিল সম্পাদন বা রেজিস্ট্রেশন হবে না। আপনার নিজের সম্পত্তি সন্তান-সন্ততি বা নিকট আত্মীয় কাছে হেবা করতে গেলে এর পূর্বে অবশ্যই এই শর্তগুলো পালন করতে হবে।
এর কোন একটি শর্ত আপনি অমান্য করলে হেবা দলিল এর কার্যকারিতা থাকবে না। তাই বলা যায় হেবা দলিল করার জন্য এই শর্তগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হেবা দলিল কে কাকে করতে পারে।
আলোচনার এই অংশে যে বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করব সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা হল হেবা কে কাকে করতে পারে। হেবা কে কাকে করতে পারে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজে ভ্রান্ত কিছু ধারণা রয়েছে। আলোচনা শুরুতেই আপনি জানতে পেরেছেন শুধুমাত্র রক্তের সম্পর্কে আত্মীয়দের মধ্যে হেবা দলিল সম্পাদন করা যায় অন্যান্য ক্ষেত্র আপনি দানপত্র করতে পারেন সেটি অন্য আলোচনা। কে কাকে হেবা করতে পারবে এটি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি।
আমাদের দেশে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মুসলিম আইনের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মুসলিম আইনের বাহিরে গিয়ে সম্পত্তি বন্টনের কোন সুযোগ নেই। কে কাকে হেবা করতে পারবে এটি সম্পর্কে মুসলিম আইনে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া রয়েছে।
কোন প্রকার বিনিময় ছাড়া নিম্নলিখিত রক্তের সম্পর্কের স্বজন ও আত্মীয়দের মধ্যে হেবা দলিল সম্পাদন করা যায়। যেমন-
- স্বামী ও স্ত্রীর
- পিতা-মাতা ও তাদের সন্তান
- ভাই -ভাই, বোন- বোন ও ভাই- বোন
- দাদা-দাদি, নানা- নানি ও তাদের নাতি- নাতনি
এবার আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে কাদের মধ্যে হেবা দলিল সম্পাদন করা যায়। শশুর তার ছেলের বউকে হেবা দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি দিতে পারেন না এক্ষেত্রে তিনি দানপত্র করতে পারেন।
এছাড়া হেবা দলিল দাতা রেজিস্ট্রি ফি ৪.৫% প্রদান সাপেক্ষে কোন নাবালক বরাবর হেবা দলিল করে দিতে পারবেন। আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। যেমন- মসজিদ মাদ্রাসায় জমি দান করে এটার হেবা করা যায়।
এই ধরনের হেবা বা দানকে জীবনীস্বত্বে দান বলে। এভাবে কেউ কোনো সম্পত্তি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দান করলে দান গ্রহীতা এই সম্পত্তি আজীবন ভোগ করতে পারবেন তবে বেচা বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না।
হেবা দলিল বাতিল করার নিয়ম।
আমাদের সমাজে অনেকেই রয়েছেন রাগের মাথায় অথবা ভুলবশত বা অন্য কোন কারণে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কারো কাছে নিজের সম্পত্তি হেবা দলিলের মাধ্যমে দিয়ে থাকেন। হেবা দলিল সম্পাদনের পর এ দলিল বাতিল হওয়ার সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে বা কারণ রয়েছে।
অন্যদিকে হেবা দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর বাতিল না হওয়ার নির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। তবে হেবা দলিল সম্পাদনের পর চাইলে কেউ এই দলিল বাতিল করতে পারবেন না। নির্দিষ্ট কিছু কারণের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে হেবা দলিল বাতিলের জন্য মামলা করতে হয়।
এই মামলার মাধ্যমে আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে আদালত যদি মনে করে আপনার সম্পাদিত হেবা দলিলটি বাতিলের যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে তাহলে আদালত হেবা দলিল বাতিল করে দিতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ আদালতের একতিয়ার এক্ষেত্রে আদালতকে কোন প্রকার চাপ প্রয়োগের সুযোগ নেই।
তাহলে আপনি বুঝতে পারলেন যে হেবা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন এর পর এটি বাতিল করতে চাইলে আদালতে মামলা করতে হবে আদালত যুক্তিসঙ্গত কারণে প্রেক্ষিতে হেবা দলিল বাতিল করার ক্ষমতা রাখে।
হেবা দলিল কি বাতিল করা যায়।
হেবা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন এর পর দানকৃত সম্পত্তি দলিল গ্রহীতা কে বুঝিয়ে দিলে বা দখল দিলে এটি আর বাতিল করার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। তবে বিশেষ কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণে হেবা দলিল বাতিলের সুযোগ রয়েছে। যেমন-
- দখল প্রদানের পূর্বে হেবা দলিল বাতিল করা যায়। কেননা হেবা দলিল কার্যকর হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো সম্পত্তির দখল বুঝিয়ে দেওয়া।
- দাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে দান করতে বাধ্য করলে।
- ভয়-ভীতি বা কোন বিনিময়ের প্রলোভন দেখিয়ে দান করতে বাধ্য করলে।
- হেবা দলিলের শর্ত অঙ্গ হলে।
- দখল প্রদানের পূর্বে দানের মানসিকতা পরিবর্তন হলে।
যেসব ক্ষেত্রে হেবা দলিল বাতিল করা যায় না।
মুসলিম আইন অনুযায়ী নিজের সম্পত্তি অন্যকে হেবা করার সুযোগ রয়েছে তবে হেবা করার পূর্বে এই বিষয়ে অবশ্যই ভাবা উচিত। কেননা একবার হেবা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে এটি বাতিল করার সুযোগ খুব কম রয়েছে। আইনগতভাবে এটি বাতিল করা যায় না।
হেবা দলিল সম্পাদনের পর যেসব কারণে এই দলিল আর বাতিল করা যায় না বা আদালতের বাতিল করার কোন এখতিয়ার নেই সেই সব কারণগুলো হলো-
- দাতা ও গ্রহিতা স্বামী-স্ত্রী হলে,
- হেবা দাতা মারা গেলে,
- গ্রহীতা কর্তৃক দানকৃত সম্পত্তি অন্যত্রে বিক্রি করলে,
- দানকৃত সম্পত্তি ধ্বংস বা বিলীন হয়ে গেলে,
- হেবাদাতা সম্পত্তি গ্রহীতার কাছে দখল বুঝিয়ে দিলে,
হেবা দলিল খরচ কত।
অন্যান্য দলিল সম্পাদনের ও রেজিস্ট্রেশন খরচের তুলনায় হেবা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন এর খরচ তুলনামূলক কম। তাই নিকটাত্মীয় ও স্বজনের মধ্যে জমি বিক্রয়ের জন্য অনেকেই হেবা দলিল করতে চান এক্ষেত্রে হেবা দলিলের খরচ কত সেটি অনেকেই জানেন না। এবার দলিল করতে কত টাকা খরচ হয় এটি নিচে দেয়া হলো-
- রেজিস্ট্রেশন ফিঃ ১০০ টাকা
- স্টাম্প শুল্কঃ ১০০০ টাকা
- ই ফিঃ ১০০ টাকা
- ইন ফিঃ প্রতি ৩০০ শব্দ বিশিষ্ট এক পৃষ্ঠা বা উহার অংশবিশেষের জন্য ২৪ টাকা
- এনএনফিঃ প্রতি ৩০০ শব্দ বিশিষ্ট এক পৃষ্ঠা বা উহার অংশবিশেষের জন্য ৩৬ টাকা
- হলফনামাঃ ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প
- কোর্ট ফ্রিঃ সম্পত্তি হস্তান্তর নোটিশের আবেদনপত্রের ১০ টাকার মূল্যের কোর্ট ফি সংযুক্ত করতে হবে।
হেবা ও দানের মধ্যে পার্থক্য।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ জমিজমা ক্রয় বিক্রয় এবাদ দান এগুলো সম্পর্কে সচেতন নয় তাই অনেক সময় দেখা যায় যিনি হস্তান্তর করতে গিয়ে হেবা দলিল দানপত্র দলিল এ দুটি বিষয়কে একই মনে করে হেবা দলিল ও দানপত্র দলিলের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে যদিও পার্থক্যের পরিমাণ বেশি নয় তারপরেও এটাকে আকাশ-পাতাল পার্থক্য মানতে হবে।
হেবা দলিল ও দানপত্র দলিলের মধ্যে প্রধান যে পার্থক্য রয়েছে সেটি হল হেবা দলিল রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে সম্পাদন করা যায় আর দানপত্র দলিল যে কাউকে দেওয়া যায়।
অর্থাৎ হেবা দলিল নির্দিষ্ট সংখ্যক রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে সম্পাদিত হয় আর অন্যদিকে দানপত্র দলিল যে কাউকে করা যায় নিকট আত্মীয়, দূরের আত্মীয়, অন্য ধর্মালম্বী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে কাউকেই দানপত্র দলিলের মাধ্যমে জমি হস্তান্তর করা যায়।
হেবা দলিল ও দানপত্র দলিলের মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্য হল হেবা দলিল রেজিস্ট্রেশনের খরচ খুবই কম আর দানপত্র দলিলের রেজিস্ট্রেশন খরচ বেশি। হেবা দলিল রেজিস্ট্রেশন ফি মাত্র ১০০ টাকা, দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে জমির মূল্যের উপর ৮ থেকে ১১% রেজিস্ট্রেশন খরচ হয়।
শেষ কথাঃ
এই আর্টিকেলে হেবা দলিল সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা আপনার অবশ্যই ভালো লেগেছে এবং এই আর্টিকেলের তথ্যগুলো আপনার উপকারে আসবে বলে আমি মনে করি। জমি জমা সংক্রান্ত জ্ঞান ও সচেতনতা সীমিত হওয়ার কারণে আমরা বিভিন্ন ভাবে হয়রানি শিকার হয়ে থাকি। তাই যে কোন উৎস থেকে জমিজমা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করা আমাদের খুবই প্রয়োজন। আজকের এই আর্টিকেলটি ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।
comment url