শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন মে দিবসের ইতিহাস

এই পৃথিবী সভ্যতার হাতিয়ার যাদেরকে মনে করা হয় তারা হলেন শ্রমিক শ্রেণী। শতাব্দীর পর শতাব্দী এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার আবিষ্কারক হচ্ছেন এই শ্রমিক শ্রেণী। এক কথায় যদি বলতে হয় এই পৃথিবীকে গড়ে তুলেছে তাহলে বলতে হবে শ্রমিকদের ঘাম। আজকের আলোচনায় আমি শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করব।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন মে দিবসের ইতিহাস
শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর সাথে পহেলা মে’র একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সারা বিশ্বের দেশে দেশে পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিবস পালনের ইতিহাসের পিছনে জড়িয়ে আছে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এক করুন ইতিহাস।

মে দিবসের ইতিহাস।

দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহান মেয়ে দিবসের ইতিহাস। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারের দেশ আমেরিকাতে প্রথম এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। প্রথমদিকে এই আন্দোলন বা দাবি শুরু হয় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য। ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিলায় জুতার কারখানার শ্রমিকরা যখন ধর্মঘট করে তখন তাদের কাজ করতে হতো প্রায় প্রতিদিন ২০ ঘন্টা করে যা ছিল খুবই অমানবিক। 

এর বিপরীতে মজুরীও পাওয়া যেত সামান্য। ১৮২০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কর্ম ঘন্টা কমিয়ে আনার জন্য অসংখ্য ধর্ম পালিত হয়। ১৮২৭ সালে দৈনিক ১০ ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করার দাবিতে মেকানিকদের উদ্যোগে ফিলাডেলফিলায় গঠিত হয় বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন। ১৮৬৬ সালে বাল্টিমোরে ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শ্রমিক ফেডারেশন “ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন”। 

ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর ঐ বছরই দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৮৬৬ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের সভায় দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম শুরু হয় দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার দাবীতে শ্রমিকদের আন্দোলন। 

১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকা ফেডারেল অফ লেবার ১ মে তারিখ থেকে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার প্রস্তাবটি গ্রহণ করে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৮৮৬ সালে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার সকল শ্রমিকরা কারখানার কাজ বন্ধ করে রাস্তায় বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন অর্থাৎ শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেন। 

আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৮৮৬ সালের ১ মে তারিখে শিকাগোতে শ্রমিকদের এক বিশাল সমাবেশ হয়। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এর আগে শ্রমিকদের এত বড় আন্দোলন লক্ষ্য করা যায়নি। সেই দিনের সেই আন্দোলন ৮ ঘন্টা কাজ করার চূড়ান্ত আন্দোলনের রূপ নেয়। ৩ মে শিকাগোর একটি কারখানা শ্রমিকরা ধর্মঘট ও সমাবেশ শুরু করেন শ্রমিকদের এই সমাবেশে বা ধর্মঘটের উপর পুলিশের আক্রমণে ৪ নিহত হন। 

পরের দিন এর প্রতিবাদে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকরা এক প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করেন এই সমাবেশে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা মারে এতে পুলিশের একজন সদস্য নিহত হন। এরপর শুরু হয় পুলিশ এবং শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ, সংঘর্ষে ৪ জন শ্রমিক এবং ৭ জন পুলিশ নিহত হন।

রক্তে রঞ্জিত হয় হে মার্কেট চত্বর। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ ৪ জন আন্দোলনকারী নেতাকে গ্রেপ্তার করেন এবং প্রহসন মূলক বিচারের মাধ্যমে তাদেরকে জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। দৈনিক ৮ ঘন্টা কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করার জন্য শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ বর্তমান সারা বিশ্বে পহেলা মে দিবসে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

মে দিবস কবে কোথায় প্রথম পালিত হয়।

আলোচনার এই অংশে পৃথিবীর কোন দেশে বা কোন মহাদেশে প্রথম মে দিবস পালন শুরু হয় এই বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। পৃথিবীর এক এক দেশে একেক নামে এই দিবসটি পালন করা হলেও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য একই। কোথাও এই দিনটিকে শ্রমিক দিবস, কোথাও মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, শ্রমিক সংহতি দিবস বিভিন্ন নামে উদযাপন করা হয়। 

পৃথিবীর প্রায় ৯০টি দেশে এই দিনটি যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সহিত পালন করা হয়ে থাকে। এ সকল দেশের এই দিনটি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া অন্যান্য দেশে বেসরকারিভাবে এই দিনটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে পালন করা হয়। মহান মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আলাদা আলাদা ভাবে বা যৌথভাবে মিছিল, সেমিনার, প্রতিবাদ সমাবেশ, র‌্যালি বের করে।

আমেরিকা মহাদেশ

আমেরিকা ও কানাডায় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার লেবার ডে উদযাপিত হতো। এ দুটি দেশে শুধুমাত্র সমাজতন্ত্রী এবং বিশ্বায়ন বিরোধী সংগঠনগুলো পহেলা মে দিবস উদযাপন করতো। দক্ষিণ আমেরিকার দেশসমূহে এই দিবস অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করা হয়। ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশগুলোতে মে দিবস, লেবার ডে, ওয়ার্কর্স ডে নামে এই দিবসটি পরিচিত। 

আর্জেন্টিনায় সর্বপ্রথম এই দিবসটি পালিত হয় ১৮৯০ সালে। পহেলা মে দিবস আর্জেন্টিনায় সরকারি ছুটির দিন। দক্ষিণ আমেরিকার আরেকটি দেশ চিলিতে ১৯৩১ সাল থেকে এই দিনটি পালন করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশ যেমন ব্রাজিল, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা, পেরু, মেক্সিকো ও উরুগুয়ে এসব দেশসমূহে মে দিবস লেবার ডে হিসেবে পরিচিত। 

এই দিন এইসব দেশের সরকারি ছুটি থাকে। দক্ষিণ আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবায় সবচাইতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই দিনটি পালিত হয়। কিউবার রেভিলিউশন স্কয়ারের লক্ষ লক্ষ ছাত্র শ্রমিক জনতা মিছিল নিয়ে জড়ো হয়। এই সমাবেশে যোগদানের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমন্ত্রণ জানান হয়।

ইউরোপ মহাদেশ

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সাধারণত মধ্য ইউরোপের দেশসমূহে ও পূর্ব ইউরোপের দেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় মে দিবস উদযাপিত হয়। ১৮৯০ সাল থেকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে মে দিবস পালন করা শুরু হয়। বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান দেশে এই দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে মনে করা হয়। 

ইউরোপের আরেকটি দেশ পোল্যান্ড ১৯৯০ সাল থেকে মে দিবসকে স্টেট হলিডে নামকরণ করে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়, শুধুমাত্র নেদারল্যান্ড ও পর্তুগাল এই দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ছুটি দেওয়া হয় না তবে দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়।

আফ্রিকা মহাদেশ

আফ্রিকা মহাদেশ ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস সরকারি ছুটির মধ্য দিয়ে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়। এ দিবসকে কেন্দ্র করে বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করা হয় আফ্রিকা মহাদেশের দেশে দেশে।

এশিয়া মহাদেশ

১৯ শতকের শুরুর দিক থেকে এশিয়া মহাদেশে মে দিবস উদযাপন হতে শুরু করে। এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে এই দিবসটি পালন করে থাকে। যেমন- শ্রমিক দিবস, শ্রমিক সংহতি দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, মে দিবস, শ্রমিক অধিকার দিবস ইত্যাদি। এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ কম্বোডিয়ায় এই দিনটিকে ছাত্র শ্রমিক দিবস নামে ডাকা হয়। 

এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এই সরকারি ছুটি থাকে। এই দিনকে উপলক্ষ করে দেশে দেশে সভা সমাবেশ, সেমিনার ,মুক্ত আলোচনা সভা, র‌্যালি বের করা হয়।

বাংলাদেশে মে দিবস পালনের ইতিহাস।

ভারতীয় উপমহাদেশে মে দিবস পালন শুরু হয় মাদ্রাজে ১৯২৩ সালে। ব্রিটিশ আমলে বাংলার শিল্প সাহিত্যের কেন্দ্রস্থল কলকাতায় সর্বপ্রথম মহান মে দিবস অনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় ১৯২৭ সালে একই সময়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ মে দিবস পালিত হয় ১৯৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জের মে দিবস পালন করা হয় বলে কিছু কিছু জায়গায় তা উল্লেখ করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই দেশে ট্রেড ইউনিয়ন চালু হয় যদিও এরশাদ সরকারের আমলে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে যথাযথ মর্যাদার মধ্য দিয়ে মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন শুরু হয়। 

সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করে থাকে এই দিনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আলোচনা সভা, র‌্যালি বের করে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন গুলো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এই দিবসকে কেন্দ্র করে।

মে দিবসের তাৎপর্য।

১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে যে শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজকের মহান মে দিবস আমরা পেয়েছি। মে দিবস হচ্ছে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। মে দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মালিক শ্রমিকের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়। পাশাপাশি শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয় মহান মে দিবস পালনের মধ্য দিয়ে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শ্রমিক আন্দোলনের বা মহান মে দিবসের তাৎপর অত্যন্ত সুদূর প্রসারি। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষেরা এই দিন নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে মহান মে দিবস উদযাপন করে। মে দিবসের তাৎপর্যের কথা বলতে গেলে শুরুতেই বলতে হয় সেই দিনের সেই আন্দোলনের ফসল হল শ্রমিকদের কর্ম ঘন্টা ৮ ঘন্টা নিশ্চিত করা। 

এর অতিরিক্ত সময় কাজ করলে শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরি প্রদান করতে হয় এটি শ্রমিক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন। সম্পন্ন এছাড়া কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, শ্রমিকদের আবাসস্থল এর ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এইগুলো হল মহান মে দিবসের অর্জন বা তাৎপর্য।

লেখকের মন্তব্যঃ

সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতী জনগণের ঐক্য, সংহতি, সংগ্রাম ও বিজয়ের মধ্য দিয়ে রচিত হয় মহান মে দিবস। মুনাফালোভী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অমানবিক-নিপীড়নের শিকার শ্রমজীবী মানুষের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকের ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয় এই মে দিবসে। যা যুগের পর যুগ সারা বিশ্বের শ্রমজীবী জনগণকে আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যুগিয়ে চলেছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।

comment url