চুল ও ত্বকের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার

নিম গাছের ডাল, পাতা, ফুল ও ফল এর ঔষুধি গুন লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। বহু বছর ধরে এই উপমহাদেশে ভেষজ উদ্ভিদ হিসাবে নিম গাছের পাতা বা ডাল এর কার্যকারিতা বিশেষভাবে প্রমাণিত। আজকে চুল ও ত্বকের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার সম্পর্কে আপনাদের জানাবো।
চুল ও ত্বকের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার
প্রিয় পাঠক, আমার এই আলোচনায় চুল ও ত্বকের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার সম্পর্কে জানার পাশাপাশি আপনারা আরো জানতে পারবেন নিমপাতা দিয়ে গোসল করার উপকারিতা এবং চর্মরোগ সারাতে নিম গাছের ডাল ও পাতার ব্যবহার কিভাবে করবেন এই সম্পর্কে-

চুলের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার।

ভারতীয় উপমহাদেশে অতি প্রাচীনকাল থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ নিম পাতার ব্যবহার হয়ে আসছে। নিম পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যা চুলের সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এক নিম পাতায় রয়েছে প্রায় সব সমস্যার সমাধান আসুন এবার আমরা চুলের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার নিয়ে কিছু আলোচনা করি-

চুলের খুশকি সমস্যার দূরীকরণ।

উপকরণঃ নিমপাতা, গোলাপের পাপড়ি, মসুর ডাল ও মেথি।

একই পরিমাণ নিম পাতা ও গোলাপের পাপড়ি এবং সেগুলোর দ্বিগুণ অনুপাতে মসুর ডাল ও মেথি নিন। অন্য একটি পাত্রে মসুর ডাল ও মেথি আলাদা করে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। এরপর সকালে উঠে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে এর সঙ্গে নিমপাতার রস মিশিয়ে নিন। এরপর গোলাপের পাপড়ির সঙ্গে পানি দিয়ে ব্লেন্ড করে পেস্ট বানিয়ে নিন। 

নিমপাতা, গোলাপের পাপড়ি, মসুর ডাল ও মেথির মিশ্রণ একসঙ্গে মিশিয়ে নতুন একটি প্যাক তৈরি করে নিন। গোসল করতে যাওয়ার ঠিক ৩০ মিনিট আগে এই প্যাকটি আপনার মাথায় ভালোভাবে লাগিয়ে নিন। সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুইবার এই প্যাক ব্যবহারের ফলে আপনি আপনার মাথার খুশকির দূর করতে সক্ষম হবেন। আপনার মাথায় যদি উকুনের সমস্যা থাকে সেটাও দূর হয়ে যাবে।

চুল পড়া রোধ করে।

উপকরণঃ নিমপাতা, অ্যালোভেরা, আমলকি ও শিকাকাই।

উপরের উপকরণগুলো ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিয়ে এর সঙ্গে সামান্য কর্পূরের গুড়ো মিশিয়ে নিয়ে এক ধরনের প্যাক তৈরি করে নিন। এই প্যাকটি আপনার মাথায় ৩০ মিনিট মেখে রেখে দিন। তারপর হালকা গরম পানি সাহায্যে তা ধুয়ে ফেলুন। এভাবে সপ্তাহে তিন দিন এটি ব্যবহারের ফলে আপনার মাথায় নতুন গজাবে এবং চুল পড়ার সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।

ভেষজ কন্ডিশনার।

উপকরণঃ নিমপাতা, মধু ও ডিম।

চুল সিল্কি রাখতে আমরা বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের কন্ডিশনার কিনে ব্যবহার করে থাকি তবে আপনি চাইলেই ঘরোয়া ভাবে উপরের উপাদান গুলোর সঠিক পরিমাণের নিয়ে এক ধরনের প্রাকৃতিক কন্ডিশনার তৈরি করতে পারেন। চলুন কিভাবে এটি তৈরি করবেন এবং ব্যবহার করবেন এখন এই সম্পর্কে কিছু বলা যায়-

শুকনো নিমপাতার গুড়ো দুই (২) টেবিল চামচ, দুই (২) টেবিল চামচ মধু ও একটি ডিম একসঙ্গে মিশিয়ে একটি প্যাক বানিয়ে নিন। এরপর চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত একটি লাগিয়ে এক ঘন্টা ধরে রেখে দিন। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে এক দুই দিন ব্যবহারে চুল হবে মলায়েম ও ঝকঝকে। এর সাথে চুলের গোড়াও হবে মজবুত।

চুলের রুক্ষতা দূরীকরণ।

উপকরণঃ নিমপাতা, মেহেদী গুড়া, চা, কফি, দই ও লেবু।

একই পরিমাণ নিমপাতা মেহেদী গুড়া সঙ্গে অর্ধেক অনুপাতে চা কফি সামান্য দই লেবুর রস দিয়ে এক ধরনের পেস্ট তৈরি করুন। পেস্টটি আপনার মাথায় আধা ঘন্টা মাখিয়ে রেখে দিন এবং ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাকটি আপনি সপ্তাহে দুইবার ব্যবহার করুন এতে করে আপনার চুল হবে কোমল এবং রুক্ষভাবে দূর হয়ে যাবে।

ত্বকের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার।

ত্বকের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার অতি প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা দীর্ঘ সময় ধরে রোদে কাজ করে থাকেন। দীর্ঘ সময় রোদে কাজ করার কারণে আমাদের ত্বকে কালো দাগ পড়ে যায়। নিম পাতায় রয়েছে এই কালো দাগ দূর করার কার্যকরী ঔষধি গুণ। এছাড়া এটি ত্বকের ব্ল্যাকহেড দূর করতে ও ভূমিকা রাখে। 

ত্বকের উজ্জ্বল ও সুন্দর লাবণ্যতা ফিরিয়ে আনতে আপনি চাইলে ঘরোয়া ভাবে নিম পাতার ফেসপ্যাক বানিয়ে আপনার ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। ত্বকের যত্নে নিমপাতার ফেসপ্যাক কিভাবে বানাবেন ও ব্যবহার করবেন তা উল্লেখ করা হলো-

প্রথমে নিমপাতা পানিতে এক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন, তারপর ভিজানো নিমপাতা বেটে নিন, এরপর ৪০ মিনিট ধরে এই ফেসপ্যাকটি আপনার ত্বকে লাগিয়ে রাখুন। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

তিনটি (৩) নিমপাতা দুইটি (২) তুলসী পাতা দুইটি (২) পুদিনা পাতা ও একটি (১) লেবুর রস মিশিয়ে ব্লেন্ড করে নিন। পাতলা মিশ্রণ তৈরি হলে পরিমাণ মতো তাতে হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করে নিন। মিশ্রণটি আপনার ত্বকে ১৫ মিনিট লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন।

নিমপাতা শুকিয়ে গুড়ো করে নিন পরিমাণ মত গোলাপজল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। ফেসপ্যাকটি ১৫ মিনিট ত্বকে লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন।

এক (১) চা চামচ নিমপাতার গুড়া এর সাথে এক (১) টেবিল চামচ বেসন ও পরিমান মত টক দই মিশিয়ে এক ধরনের পেস্ট বানিয়ে নিন। ১৫ মিনিট আপনার ত্বকে লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন।

কিছু নিমপাতা বেটে নিয়ে এক টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে ত্বকে লাগানো কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন।

অ্যালোভেরা জেল ও শুকনো নিম পাতার গুঁড়ো একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করুন ফেসপ্যাক । তারপর আপনার তোকে ২০ মিনিট লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন।

আপনার ত্বকের সৌন্দর্যতা বৃদ্ধির জন্য নিমপাতার সঙ্গে অন্যান্য ঔষধি গুন সম্পন্ন উপাদান মিশিয়ে নির্মিত আপনার ত্বকে নিয়মিত ব্যবহার করুন। আপনার ত্বক হয়ে উঠবে রূপ লাবণ্যময়।

চর্মরোগে নিম পাতার ব্যবহার।

বাংলাদেশে একেক ঋতুতে একেক ধরনের চর্মরোগ আমাদের শরীরে দেখা যায়। এসব চর্ম রোগ থেকে বাঁচতে আমরা বিভিন্ন ধরনের ঔষধ, পাউডার বা মলম ব্যবহার করি এবার আমরা চর্ম রোগের নিম পাতার ব্যবহার সম্পর্কে জানব-

নিম পাতায় রয়েছে আন্টি ব্যাকটেরিয়াল এবং এন্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য যুক্ত গুণ যা চর্মরোগ ভালো হতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দাউদ, চুলকানি, একজিমা ও ফোড়া দেখা যায় ওইসব জায়গায় নিম ব্যবহার করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। 

এই জন্য আপনাকে যা করতে হবে তা হল পুরনো নিম গাছের শুকনো ছাল তুলে মিহি করতে হবে এরপর তিন গ্রাম পাউডার এক গ্লাস পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে মধুর সঙ্গে মিশে খেতে হবে এতে করে আপনার চর্ম রোগে কিছুটা নিরাময় হবে। আমরা যারা একজিমার বা দাউদের সমস্যায় ভুগি আক্রান্ত স্থানে নিমের পাতা হালকা করে বেটে ব্যান্ডেল করে লাগালে খুব দ্রুত সেরে ওঠে।

নিম পাতা দিয়ে গোসল করার উপকারিতা।

নিম গাছের পাতা, ডাল, ফুল ও ফল সব কিছুতেই রয়েছে ঔষধি গুণ। গরম পানিতে নিমপাতা দিয়ে গোসল করার রয়েছে কয়েকশ বছরের ঐতিহ্য। মানব দেহের বিভন্ন অঙ্গের বিশেষ করে ত্বকের সমস্যা, চুলের সমস্যা, এলার্জির সমস্যার সমাধান রয়েছে এ নিম পাতায়। পাশাপাশি ছোট বাচ্চাদের সর্দি-কাশি, জ্বর প্রতিরোধে নিম পাতার কার্যকারিতা রয়েছে। আসুন গোসলের সময় নিম পাতার ব্যবহার কিভাবে করবেন তা জেনে নেই-

গরম পানিতে কিছু নিম পাতা ফেলে দিয়ে মিনিট পাঁচেক রেখে দিই এরপর সেই পানি ঠান্ডা করে গোসল করা যেতে পারে এতে করে আপনার ত্বক ও চুলের উপকার হবে। নিমপাতায় রয়েছে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল ও এন্টি ফাঙ্গাল যা খুশকি রুখতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। 

গরমের সময় যাদের শরীরে র‌্যাশ বের হয় তা দূর করে নিমপাতা। যারা বেশি সময় আদ্র আবহাওয়ায় থাকেন প্রতিদিন তারা নিমপাতা ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাবেন।

নিম পাতার ক্ষতিকর দিক।

আয়ুর্বেদী চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রমাণ মিলেছে যে প্রকৃতির এক অপূর্ব আশ্চর্যজনক সৃষ্টি এই নিম পাতা। হাজারো গুণে গুণান্বিত হলেও নিমপাতার কিছু ক্ষতিকর দিক এখন আপনাদের সামনে তুলে ধরব-
  • কারো যদি কিডনি ও লিভারের সমস্যা থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিম পাতা খাওয়াই উত্তম।
  • ত্বকে অতিরিক্ত নিমপাতা আপনার ত্বকে এলার্জির সমস্যা কে বাড়িয়ে দিতে পারে।
  • বিবাহিত নারী পুরুষদের নিমপাতা না খাওয়াই ভালো।

লেখক এর মন্তব্যঃ

প্রিয় পাঠক আশা করি উপরের পোস্টটি পড়ে আপনারা নিমপাতার বিভিন্ন ব্যবহার সম্পর্কে একটি সম্মুখ ধারণা পেয়েছেন। এই ধরনের আরো পোস্ট পেতে আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে সঙ্গে থাকুন। আসুন আমরা আমাদের বাড়ির আশেপাশের পতিত জায়গায় ওষুধি গাছ লাগাই রোগ বালাই দমন করি।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।

comment url