বিদেশ থেকে জমি রেজিস্ট্রি কিভাবে করবেন
জমি জমা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়াদি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। এজন্য জমি ক্রয় বিক্রয় বা জমি রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বিভিন্ন সময় আমরা হয়রানির শিকার হয়ে থাকি । বিদেশ থেকে জমি রেজিস্ট্রেশন কিভাবে করবেন এবং জমি রেজিস্ট্রেশন করার খরচ কত? সেই সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই বললেই চলে।
আজকে এই আলোচনায় আমরা এগুলো বিষয় নিয়েই বিস্তারিত জানব । আশা করি সমগ্র পোষ্টটি আপনারা ধৈর্য সহকারে পড়বেন , তাহলে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা পেয়ে যাবেন । তা না হলে আমাদের পড়তে হবে দালালদের খপ্পরে এতে করে আমাদের সময় ও টাকা নষ্ট হয়ে যাবে ।
দলিল রেজিস্ট্রেশন কি ?
১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী কোন জমি বা ভূখণ্ড হস্তান্তর করতে হলে বা মালিকানা পরিবর্তন করতে হলে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের নির্ধারিত ফর্মে ক্রেতা বিক্রেতার চাহিদা মাফিক তথ্যাদি ও দলিলাদে উল্লেখ করে যে নিবন্ধন করা হয় এবং যাতে জমি পরিচিতি উল্লেখ থাকে যা দলিলের লেখা হয় এ ধরনের দলিল সাব রেজিস্টার এর মাধ্যমে নিবন্ধিত করাকে রেজিস্ট্রি বলে ।
যে ক্ষেত্রে দলিলদাতা অথবা গ্রহিতা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে পারেনা সেক্ষেত্রে যেকোনো পক্ষের চাহিদা মোতাবেক সাব রেজিস্টার কমিশনের মাধ্যমে দলিল রেজিস্ট্রি করতে পারেন ।
দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে কি কি লাগে ?
- সংশ্লিষ্ট জমির সিএস, এসএ ,আরএস, বিএস, বিআরএস অথবা নামজারি খতিয়ানের মূল কপি ।
- হালসন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিষদের রশিদ ( দাখিলা) ।
- ক্রেতা এবং বিক্রেতা গনের জাতীয় পরিচয় পত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট এর ফটোকপি ।
- উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ওয়ারিশ সনদ ।
- ক্রেতা এবং বিক্রেতা গনের সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি ।
- প্রয়োজনীয় বায়া দলিল সমূহের মূল কপি ( প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ।
- সিটি কর্পোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং জেলা সদরের পৌরসভার অধীন ১০০০০০/- টাকার বেশি মূল্যের সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিলে ক্রেতা এবং বিক্রেতার E-TIN ।
কোন কোন দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে হয় ?
- বিক্রয় দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে ।
- জমি ক্রয় করার আগে বায়না দলিল করলে ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশনের জন্য জমা দিতে হবে ।
- বায়না দলিল রেজিস্ট্রি তারিখ থেকে এক বছরের মধ্যে বিক্রয় দলিল সাব রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করতে হবে ।
- হেনা বা দানকৃত সম্পত্তির দলিলও রেজিস্ট্রি করতে হবে ।
- বন্ধকৃত জমির দলিল রেজিস্ট্রি করতে হবে ।
- কোন ভূমির সম্পত্তির মালিকের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি বাটোয়ারা করা এবং ওই বাটোয়ারা বা আপোষ বন্টন রেজিস্ট্রি করতে হবে ।
দলিল সম্পাদনের কত দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়?
রেজিস্ট্রেশন আইনের ১৭ এ ধারা অনুসারে বায়না পত্র সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশনের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করতে হয় এবং উক্ত আইনের ২৬ ধারা অনুসারে বিদেশে সম্পাদিত কোন দলিল বাংলাদেশে প্রবেশের তারিখ থেকে চার মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রির জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করা যায় ।
জমি রেজিস্ট্রেশন করার খরচ কত ?
জমি রেজিস্ট্রেশনের খরচ মূলত জমির মূল্যের উপর নির্ভর করে । জমি রেজিস্ট্রেশনের খরচ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয় এর ধাপগুলো নিম্নরূপ -
সাধারণভাবে আমরা দলিল রেজিস্ট্রির জন্য রেজিস্ট্রি ফি, অতিরিক্ত কর, উৎস কর , জেলা ও পৌর কর ইত্যাদি ফিস হিসাব করে থাকি । সকল দলিলের ফিসের হার সমান নয় , দলিলের প্রকৃতি ও এলাকা অনুসারে তার ফিসের হার নির্ধারিত হয়ে থাকে । নিম্নে খাতওয়ারি ফিশ আলোচনা করা হলো-
রেজিস্ট্রেশন ফ্রি: হস্তান্তরিত সম্পত্তির দলিলে লিখিত মোট মূল্যের মূল্যের ১%
স্টাম্প শুল্ক ফ্রি : হস্তান্তরিত সম্পত্তির দলিলে লিখিত মোট মূল্যের ১.৫%
স্থানীয় সরকার কর : হস্তান্তরিত সম্পত্তির দলিলে লিখিত মোট মূল্যের ৩%
উৎস কর : জেলা সদরের পৌরসভা ব্যতীত অন্যান্য পৌরসভার ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের উপর ২% টাকা অন্যান্য এলাকার জন্য দলিল মূল্যের উপর ১% টাকা নির্ধারিত হয় । এলাকার অবস্থান ভেদে জমির দলিল খরচ বিভিন্ন হয়ে থাকে।
অন্যান্য ফি
- হলফনামা স্ট্যাম্প ৩০০ টাকা
- ই ফি ১০০ টাকা
- এন ফি ১৬০ টাকা
- এনএন ফি ২৪০ টাকা
- কোর্ড ফি ১০ টাকা
উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক,
কোন মৌজার ১০ শতাংশ জমির মূল্য ৫,০০,০০০/= তাহলে ,
রেজিস্ট্রি ফি =৫০০০০০/-এর ১%=৫০০০/-টাকা ।
স্টাম্প শুল্ক ফ্রি=৫০০০০০/- এর ১.৫%=৭৫০০ টাকা ।
স্থানীয় সরকার ফি=৫০০০০০/-এর ৩%=১৫০০০ টাকা ।
উৎস কর ফি=৫০০০০০/- হ্যালো ২%=১০০০০ টাকা । (পৌরসভা এলাকা)
=৫০০০০০/- এর ১%=৫০০০ টাকা । (ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা)
জমি রেজিস্ট্রি করার পর কি করতে হয় ?
মামলা মকর্দমা থেকে বাঁচতে হলে যে কোন দলিলের মাধ্যমে বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিতে আপনার মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে হবে-
- দলিল রেজিস্ট্রার পর আমিন দ্বারা জমি মেপে সীমানা নির্ধারণ করে পূর্বের মালিকের কাছ থেকে জমি দখল বুঝে নিতে হবে ।
- জমিতে আপনার দখল প্রতিষ্ঠার জন্য জমির উপর ঘরবাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি করতে হবে ।
- রেজিস্ট্রি অফিস থেকে মুল দলিল পেতে দেরি হলে মূল দলিলের নকল বা সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করতে হবে ।
- দলিলের নকল প্রাপ্তির পর দ্রুত সংশ্লিষ্ট সহকারী (ভূমি) কমিশনার অফিসে আবেদন করে নিজ নামে নামজারি (খারিজ )করে নিতে হবে ।
- দখল এবং নামজারি করতে দেরি হলে অসাধু বিক্রেতা আপনার ক্রয় করা জমি অন্য জায়গায় বিক্রি করতে পারে ।
- সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের নামজারি হলে নামজারি খতিয়ান এবং ডিসিআর সংগ্রহ করতে হবে এবং নতুন হোল্ডিং এর উন্নয়ন কর অর্থাৎ খাজনা পরিশোধ করে দাখিলার কপি সংগ্রহপূর্বক সংরক্ষণ করতে হবে ।
- নিয়মিতভাবে প্রতিবছর ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ করতে হবে ।
বিদেশ থেকে জমি রেজিস্ট্রেশন কিভাবে করবেন ?
বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাস জীবন যাপন করে। অনেকেরই প্রবাসে থাকাকালে দেশের জমি বিক্রয়ের প্রয়োজন হয় । আবার দেখা যায় এজম্যালি সম্পত্তি কোন অংশীদার প্রবাসে থাকায় জমি বিক্রয়ের সমস্যা হচ্ছে । এসব সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায় ।আইন অনুযায়ী আপনি প্রবাসে থেকে দেশের সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারবেন ।
এজন্য আপনাকে যা করতে হবে তা - একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর নিকটে গিয়ে বিক্রয়ের পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দলিল তৈরি করতে হবে এক্ষেত্রে যেসব তথ্যের প্রয়োজন হবে -পাওয়ার দাতার নাম ঠিকানার বিস্তারিত বিবরণ, পাওয়ার গ্রহিতার নাম ঠিকানার বিস্তারিত বিবরণ, জমির পরিমাণ ও অবস্থানের বিবরণ ।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নির দলিল তৈরি হলে ডাক যোগে দলিল ও পাওয়ার গ্রহিতার পাসপোর্ট সাইজের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি ,পাওয়ার দাতা প্রবাসী ঠিকানায় প্রেরণ করতে হবে। ডাক প্রাপ্তির পর পাওয়ার দাতাকে তার নিজের পাসপোর্ট সাইজের এক কপি ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি নিয়ে অবস্থানরত দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হবে ।
দূতাবাসে গিয়ে পাওয়ার দাতা একজন কাউন্সিলরের সামনে দলিলের স্বাক্ষর করবেন । কাউন্সিলর নিজেও উক্ত দলিলের স্বাক্ষর করবেন । প্রয়োজনীয় কাজ শেষে পাওয়ার দাতা দলিলটি ডাক যোগে দেশে প্রেরণ করবেন । পাওয়ার গ্রহীতা ডাক হতে দলিলটি গ্রহণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই দলিলটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সত্যায়িত করে দেবেন ।
এরপর পাওয়ার গ্রহিতাকে দলিলটি নিয়ে ডিসি অফিসের রাজস্ব কার্যালয় যেতে হবে । সেখানে দলিলটিতে আঠা যুক্ত প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প লাগানো হবে । এখন পাওয়ার গ্রহীতা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে জমির পাওয়ার অফ এটনির দলিলের শর্ত অনুযায়ী হস্তান্তর করতে পারবেন ।পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির শর্ত অনুসারে পাওয়ার গ্রহীতা কর্তৃক সব ধরনের হস্তান্তর এমনভাবে কার্যকর হবে যেন হস্তান্তরটি পাওয়ার দাতা কর্তৃক সম্পন্ন হয়েছে ।
লেখকের মন্তব্যঃ
জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ জমি ক্রয় বিক্রয় করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হয় । এই পোস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে জমিজমা সংক্রান্ত প্রাথমিক কিছু ধারণা দেয়ার । যাতে করে জমি জমা সংক্রান্ত বিষয়ে তারা হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার না হয় ।
সাগর অনলাইন সিও নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।
comment url